গত চারদিন থেকে সমস্যাটা হচ্ছে, ডান হাঁটুর নিচে একটা চিনচিনে যন্ত্রণা, সকালবেলা, মানে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ানোর অভ্যেস আমার অনেককাল। রোজ না পারি, সপ্তাহে চার-পাঁচ দিন আমি উঠি, তারপরে একটু পরিষ্কার হয়ে জামাপ্যান্ট চেঞ্জ করে কানে হেডফোনটা গুঁজে বেড়িয়ে পড়ি। তারপরে ঘণ্টাখানেক হেঁটে, দৌড়িয়ে হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে সাতটার মধ্যে ঘরে ফিরে আসি। অবশ্য ম্যারাথনটা তারপরেই শুরু হয়, বেলাদি আমার কাজের লোক, আমার জন্যে যতক্ষণে ব্রেকফাস্ট বানায়, আমি ততক্ষনে স্নান সেরে, ঠাকুরকে অল্প ফুল বেলপাতা দিয়ে তৈরি হয়ে নিই অফিসের জন্যে।
বেলাদি সকালে এসে ব্রেকফাস্ট বানায়, তারপরে দুপুরের খাবার রান্না করে, টিফিনে ভরে দিয়ে চলে যায়। আরও দুতিন বাড়ি কাজ করে বোধয়। বিকেলে আরেকবার আসে, তখন ঘর ঝাঁট দেয়, মোছে, আর রাতের খাবার রান্না করে দেয়। তেল মশলা কম দেয় আর এক্কেবারে দিদির মত যত্ন নিয়ে কাজ করে। একটা চাবিও দেওয়াই থাকে, কারণ বিকেলে যখন আসে বেলাদি, আমি তখন ফিরিনা। বেলাদি নিজের মত কাজ করে, আমার জন্যে খাবার ঢাকা রেখে চলে যায়। বেলাদির সঙ্গে আমার কথা বলার দরকার পরে না, খুব দরকারি কিছু না হলে। সেই দরকারিটা বেশিরভাগ সময়েই পরেরদিন আমি থাকবো না, আসার দরকার নেই, এই কথা টা বলার জন্যেই ব্যবহার হয়। আমার মনেও পড়েনা শেষ কবে আমি বেলাদির সঙ্গে কথা বলেছি। বেলাদিই মাঝে মাঝে কিছু পাড়ার খবর দিয়ে যায়, কিছু মশলাপাতি আনতে হলে বলে যায়, আর নিজে যদি ছুটি নিতে চায়, তখন একবার বেরনোর আগে জানিয়ে দিয়ে যায়, ব্যাপারটা অনেকটা নেহাত আপনি ভাববেন, তাই জানালাম, নাহলে ভাববেন না যেন অনুমতি নিচ্ছি। আমিও কেবল মাথা নেড়ে অধিকাংশ দিন কথা বলার কাজ সেরে নিই।
আমার স্বাভাবিক জীবন, বিবাহ একটা হয়েছিল, টেকেনি, চাকরি একটা করি, ভালই মাইনে দেয়, সুসময়ের, অসময়ের জন্যে কোনও বান্ধবী বা অন্য কারও বউ নেই, সত্যি বলতে আমার কিছুই নেই, চাকরি আর এই থাকার জায়গাটা ছাড়া। বেলাদিকে নিয়ে লিখলাম, কারণ তবুও যদি কিছু থাকার মধ্যে থাকে, সেটা এক ওই বেলাদি, যার সঙ্গেও আমার ক্বচিৎ কদাচিৎ কথা হয়। কলকাতার বাড়িতে বাবা মা আছে, একটা নিজের দিদিও আছে, তার বিয়ে হয়ে গেছে আর আমার প্রতি মোহভঙ্গ হতে হতে বাবা মা দিদি জামাইবাবু কারোরই আর আমাকে নিয়ে খুব একটা উৎসাহ নেই। আমিও আস্তে আস্তে তাদের এই মোহভঙ্গ হওয়াটা ভবিতব্য বলে চুপচাপ হজম করে গেছি। তাই আমার জ্বর সর্দি কাশি হলেও আমার সেবায় আমিই থাকি, আর হাঁটুতে চিনচিনে ব্যথা হলেও নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে হয়, কি করে হল, কেন হল আর তারপরে কি করে ঠিক হবে। আমার বন্ধু বান্ধবের অবশ্য অভাব নেই। আমার পয়সা আছে, তাই ফুটানি আছে, আর ফুটানি আছে বলে আমার বন্ধু বান্ধবও আছে। তারা মোটামুটি সবাইই অনেকদিনের। মাঝে মাঝে একসাথে বসি, পেটভরে মদ খাই, বা রাতেরবেলা গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি, তারপরে মাঝরাতে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি যতক্ষণ না পরেরদিন বেলাদি এসে দশ পনের বার বেল বাজিয়ে আমার ঘুমের বারোটা না বাজায়। বেলাদিকে চাবি দেওয়া থাকলেও সকালে এসে আমার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে ঢুকবে না, কারণ জানা নেই!
হাঁটুর ব্যথাটা আমাকে দুদিন ধরে কাবু করে রেখেছে। ডান পায়ের হাঁটুর ঠিক নিচে, মানে মালাইচাকির ঠিক নিচের দিকে। আঙ্গুল দিয়ে টিপলে ব্যথা নেই, চামচ দিয়ে মারলে ব্যথা নেই, ভলিনি লাগালে জ্বলে না, আইসপ্যাক দিলেও কষ্ট হয়না, শুধু দৌড়াতে গেলে বা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলেই ব্যথা টা করে। আর ব্যথা টা বেশ ব্যথা, মানে আমার চিন্তাভাবনার অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে ইতিমধ্যেই। মনে মনে ঠিক করে নিয়েছি আরেকদিন দেখবো, তারপরে ডাক্তার। শক্ত করে একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধে নিয়েছি প্যান্টের নিচে, কিন্তু তারফলে গাড়ি চালাতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল, কিন্তু কিছু করার নেই। বিকেলে সন্দীপের বাড়িতে নিমন্ত্রন আছে। আসলে আমাদের একটা দল আছে, দলটা গোপনীয়, এবং যেহেতু আমি ছদ্মনামে লিখছি, তাই আমাকে কেউই চিনতে পারবে না আর আমার বন্ধুদের নাম এমনকি আমার কাজের লোকের নামও আমি আসল লিখছি না, তাই দলের ব্যাপারটা বলে দিলে খুব সমস্যার নয়। আমাদের দলটা আসলে ছ’টা লোকের, বা বলা ভালো ছ’টা বিবাহবিচ্ছিন্ন তরুনের ক্লাব। আমরা প্রত্যেকেই বিবাহ বিচ্ছিন্ন, মানে আমাদের সবারই বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, তার সঙ্গে আরও দুটো ব্যাপারে মিল আছে, এক, আমরা প্রত্যেকেই এখন আমাদের বাবা মায়ের কাছেও একটা জঞ্ঝাট ছাড়া আর কিছু নই, আর দুই, আমরা প্রত্যেকেই সুখে আছি। আমরা মাঝে মাঝে দেখা করি, আর তারপরে অনেক কিছু করি, সেটা রাতেরবেলা মদ খেয়ে মাতলামি থেকে শুরু করে মেয়ে ভাড়া করে আনা পর্যন্ত সবই। আর বিপদে আপদে আমরা সবাই সবার একমাত্র আত্মীয়। তাই হাঁটুর ব্যথাটাও ডাক্তার দেখানোর থেকে ওদের দেখান বেশি দরকারি। আমাদের আরও অনেক বাজে কাজের মধ্যে একটা ভালো করি, যদিও সেটা ভালো না খারাপ আমরা খুব একটা সেটা নিয়ে চিন্তিত নই, কিন্তু আমরা সবাই কবিতা লিখি। আমরা মদ খেয়ে কাব্যচর্চা করি, যে যার নিজের লেখা পড়ি, কারও নতুন কবিতা মাথায় এলে মোবাইলে ভয়েস নোট করে রাখি, পরে খাতায় তুলবো বলে। তারপরে খাওয়া দাওয়া করে যে যার নিজের বাড়ি ফিরে আসি, কখনও কারও বাড়ি গিয়ে রাত্রিবাস করিনি আমরা। এর কোন কারণ নেই, নিজেদের মধ্যেও নিজেদের যৌনচেতনা নিয়ে কোনরকম ভয়ও নেই, কিন্তু এই একটা নিয়ম আমরা নিজেরাই বানিয়েছি, যাই হোক, যত রাতই হোক, বাড়ি ফিরে যাবো আমরা। আমরা একসাথে বেড়াতে গেলেও আলাদা আলাদা ঘর বুক করি। আসলে আমাদের মধ্যে কিছু নিয়ম আমরা নিজেরা তৈরি করেছি, নিজেদের কাছাকাছির মধ্যেও একটা দূরত্ব নিজেরা স্থির করে নিয়েছি, বোধয় আমাদের সবারই বিবাহিত জীবনের যে জায়গাটা সবথেকে বেশি ভঙ্গুর ছিল, সেই জায়গাটা আমরা এই বন্ধুত্বের জায়গায় আগে থেকেই নির্ধারিত করে বেঁধে দিয়েছি। গত রোববার আমার বাড়িতে ছিল পার্টি। খাবার বাইরে থেকে আনিয়েছিলাম, আর মদ আমি নিজে কিনে এনেছিলাম। সেদিন আবার আদিল এনেছিল গাঁজা, কোত্থেকে মালানা ক্রিম জোগাড় করেছে, সেটাই নিয়ে এসেছিল, মাঝ রাত পর্যন্ত চলেছিল আমাদের ‘বাবা’ ‘মা’র’ পার্টি। সৌপর্ণ আর আমি দুজনে বাঙালি, আদিল মারাঠি, সাগর দিল্লীর আর আমাদের মধ্যে সবথেকে হুল্লোড়বাজ আর সবথেকে বেশি উত্তেজক চরিত্র চন্দ্রা। চন্দ্রা কোন মেয়ের নাম নয়, চন্দ্রার পুরো নাম চন্দ্রশেখর মিশ্রা, সত্যিকারের বিহারী। সত্যিকারের বিহারী বলার কারণ হল, চন্দ্রা ইংরিজিও বলে বিহারীদের মত করে আর আমাদের মধ্যে একমাত্র লোক যে খৈনি খায়, শুধু খায় বললে ভুল হবে, গর্বের সাথে খায়। আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদও নাকি খৈনি খেতেন। ওর সঙ্গে আমরা কেউ তর্ক করিনা, কারণ হয় ও তর্কে জিতে যাবে, আর নয়তো রেগে যাবে। এই একমাত্র চন্দ্রাকে নিয়ে আমরা নিশ্চিত ওর ডিভোর্স হওয়ার পরে সত্ত্যিই দুজনেই বেঁচেছে।
সৌপর্ণ ভালো গীটার বাজায়, সে মাঝে মাঝে একটা একটা করে সুর ধরে, উঁহু উঁহু করে গুনগুন করে, কখনও আমরাও সঙ্গ দিলে গানটা শেষ হয়, নাহলে নিজেই ব্যস্ত থাকে। ওর মদ খাওয়াটা দেখে মনে হবে কতকাল যেন না খেয়ে আছে, গ্লাসে ঢালার দেরী, ঢাললেই ও নিজের গলায় ঢেলে দেবে। আদিলের আবার ধর্মের মানা, তাই ও খুব কম সময়েই আমাদের সঙ্গে মদ খায়, বেশিরভাগ সময়ে খায় গাঁজা। কোথা থেকে জোগাড় করে ওই জানে! সাগর দিল্লীর ছেলে, তাই মদ নিয়ে এক্কেবারেই বাছবিচার নেই, না বলতে শেখেনি, আমার কথা আমি আগেই বলেছি, আরেকটু বিস্তারিত বলতে গেলে সন্ধ্যেবেলার পর থেকে আমি একা থাকলেও মদ খাই, আর পার্টি তে গেলেও খাই আর পূজাপার্বণের দিনে আরও বেশি করে খাই, তবে আমি খাই খুব ধীরে, অনেক সময় নিয়ে।
পার্টিতে পৌঁছে দেখলাম আমার আগেই সবাই পৌঁছে গেছে, গীটারে টুং টাং শুরু হয়েছে, আদিল হাতের তেলোয় খৈনি ডলছে আর চন্দ্রা গ্লাস ধুচ্ছে। সাগর ল্যাপটপটা নিয়ে পড়েছে, কিছু একটা ইংরিজি সিরিজ খুঁজে বের করতে চায়। সবার কথাই বলেছি, কিন্তু সন্দীপের কথা বলিনি, কেন বলিনি, তার একটা কারণ আছে। ওটা আবার মদ না খেলে হয় না। চন্দ্রা গ্লাস টাস ধুয়ে আসার পরে আমরা সবাই বসলাম তাস নিয়ে। এটাও আমাদের একটা নিয়ম। নিজের পছন্দমত কিছু করার আগে সবার সঙ্গে সবাইকে একসাথে সময় দিতে হবে, খেলতে হবে একসাথে, তাই তাস। বিবি পাশানোর খেলা, এটা আমি ভালো পারি, তিন গেমের পরে দেখা গেল আমিই এগিয়ে, সৌপর্ণ উঠে আবার গীটার নিয়ে বসে গেল, সাগর টিভি’র সাথে ল্যাপটপ গুঁজে কিছু একটা চালানর চেষ্টা করছে, আর আমি আমার দ্বিতীয় পেগটা খেয়ে গ্লাস নামিয়ে সিগারেট ধরিয়েছি। এখন আমার স্বভাব হল, চুপ করে যাওয়া আর অন্যকে ভালকরে খুঁটিয়ে দেখা, কে কি করছে, কি বলছে, সেটা শোনা, ইচ্ছে হলে মতামত দেওয়া। সন্দীপ অনেকটা আমার মত করেই শুরু করে, আজও আমার মতই দ্বিতীয় পেগ অব্দি খেয়েছে, কিন্তু ওর দ্বিতীয় থেকেই চড়তে থাকে, তাই একটু এলোমেলো, তারপরে একটু দম নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে একটা হাই তুলে বলল, “একটা কথা বলতে চাই,” আমরা অবাক হলাম না, প্রত্যেক দিনেই ও এইসময় একটা কথা বলতে চায়, আর মজার ব্যাপার, কথাটা এমন কিছু বলে, যেটা নিয়েই তর্ক শুরু হয়, আলোচনা হয়, নেশা আরও চড়ে, মোট কথা আমরা সবাই ওর সেই কথা উপভোগ করি। গলাটা খাঁকড়িয়ে আবার শুরু করলো, “কাল রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি।“ আমরা সবাই ওর দিকে ঘুরে বসলাম, সৌপর্ণ গীটার সরিয়ে তাকাল সন্দীপের দিকে, আদিল একটা চোখ বন্ধ, আর আরেকটা খুলে তাকাল ওর দিকে, চন্দ্রা কারও বাড়ি গেলে সেখানে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নেই, লুঙ্গি পরে আছে এখন, সে লুঙ্গিটা ভালো করে ছড়িয়ে বসলো সামনের দিকে, সাগর কোয়ালিটিতে বিশ্বাস করেনা, ওর খেলা পরিমানে, এতক্ষনে তিন চারটে পেগ উড়িয়ে দেওয়ার অভ্যেস ওর, তারপরে জল খায় অনেকটা, ঘণ্টাখানেক একফোঁটা খাবে না, তারপরে আরও তিন চারটে খেয়ে তবে তার বিশ্রাম, সেও সন্দীপের দিকে তাকাল, মোটামুটি একটা মিশাইল আকাশ ফুঁড়ে উঠলো বলে! সন্দীপ সবাইকে ভালো করে ঘার ঘুরিয়ে দেখে নিল, তারপরে বলল, “কাল স্বপ্নে দেখেছি, আমি একটা নেপালি মেয়ের সাথে সেক্স করছি, আর মেয়েটা মোটামুটি পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বয়েসি, ফরসা গায়ের রং, আখের রস বিক্রি করছিল কোন একটা রাস্তায়, কালো রঙের পাজামা আর নীল রঙের ফুলহাতা জামা পরে, ডানহাতের বুড়ো আঙ্গুলে একটা ট্যাটুও ছিল, এ লেখা, তার সঙ্গে একথা সেকথার পরে প্রস্তাব দিলাম সেক্সের, সঙ্গে সঙ্গে রাজি, আমি আমার সারাদিনের কাজ করে রাতের বেলা অপেক্ষা করছিলাম হোটেলে, মেয়েটা এলো, তারপরে অনেকক্ষণ ধরে করলাম আমরা, তারপরে একসাথে ঘুমিয়ে পড়লাম, আর কিছু মনে নেই, ব্যাস, সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম রাজিয়া এসেগেছে।“ রাজিয়া ওর কাজের লোক।
আমার এই দলটাকে এত ভালো লাগার এটাও একটা কারণ, আমরা আমাদের কথাবার্তার মাঝে কোন কিছুই ছ্যাবলামি করে উড়িয়ে দি’না। হতে পারে, তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কিন্তু আমাদের নিয়মের আরেকটা নিয়ম হল, সবাই সবার কথা শুনবে, তারপরে মতামত দিতে পারবে, তাকে আহত না করে, আর মতামত না থাকলে বা মতামতে অন্য কেউ আহত হওয়ার উপাদান থাকলে, মুখে কুলুপ এঁটে থাকো। আর সবার বলার স্বাধীনতা রয়েছে, কে কি ভাবল, ভাবার দরকার নেই, শুধু এটা মনে রাখলেই হল যে, যে কথায় অন্য কেউ আঘাত পেতে পারে, সেটা না বলাই ভালো, আর যদিও বা বলেও ফেল, অন্য কেউ শুধরে দিলে সেটা মেনে নিতেই হবে। আমরা তাই যা খুশি বলি, তারপরে কেউ বারণ করলে আর বলিনা। সন্দীপের স্বপ্ন শোনার পরে আমাদের কিছু বক্তব্য থাকতে পারে কি’না, সেটা ভাবার কাজ আমার তেমন খুব একটা নয়, এইসবের দায়িত্বে থাকে সৌপর্ণ, তার এইসব ব্যপারে খুব উৎসাহ। সে জিগ্যাসা করলো, “কখন দেখেছ স্বপ্ন টা? প্রথম রাতে, না সকালের দিকে?”
– সকালের দিকে, আর কেন জানিনা মনে হল খুব জ্যান্ত সবকিছু, মানে রাতের স্বপ্ন খুব একটা মনে থাকেনা আমার, কিন্তু কাল রাতের স্বপ্ন টা হুবুহু মনে আছে আমার, সন্দীপ বলল
সাগরের এখন বিরতির সময়, মানে এই সময়ে ও কিছু খাবে না, মাঝে মাঝে সিগারেট খাবে আর শুনবে সবার কথা, চন্দ্রা বলল, কোন জায়গা কিছু মনে আছে? ভাবখানা এমন যে জায়গা বললেই ও ঠিক খুঁজে এনে দেবে সেই মেয়েটাকে। আমি একবারে হাফ গ্লাসের মত তৃতীয় পেগটা গলায় ঢেলে বললাম, “চলো নেপাল ঘুরে আসি, কিম্বা, ভূটান, কিম্বা, সিকিম যাওয়া যেতেই পারে। মেয়েটাকে খুঁজে পাওয়া যাক বা না যাক, চেপটা চোখের দেশ থেকে ঘুরে এলে মন্দ হয়না।“ কথাটা সবার পছন্দ হল। আদিল অনেকক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, ওর বোধয় নেশাটা চড়েছে। আদিলের গাড়ির ড্রাইভার আছে, বাকি আমরা নিজেরাই গাড়ি চালাই। আদিল খানিকক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা বালিশ টেনে নিয়ে আধশোয়া হয়ে বলল, “একটা জায়গায় যেতে পারি আমরা, জায়গাটা খুব দূরে নয়, কিন্তু পাহাড়ি, আর সেখানে নেপালি পাবে কিনা জানিনা, কিন্তু অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না, তাই ঘুরে এলে মনটা ভালো থাকবে।“ সন্দীপ সবার কথা শুনছিল, সবার মতামত দেওয়া হলে, নিজেই বলে উঠলো, আমি বুঝতে পারছিনা, কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ, জায়গাটা, না মেয়েটা, না সবমিলিয়ে কিছু একটা। আসলে সেক্সের ব্যপারটা না থাকলে বাকি স্বপ্নের আমি খুব একটা মানে বের করতে পারছিনা। কেনই বা আমার মেয়েটার কালো পাজামা আর নীল রঙের হাতা গোটানো জামার কথা মনে থাকবে?” সৌপর্ণ বলল, “একটু আগেই তো বললে যে ফুলহাতা জামা ছিল!” সন্দীপ জবাব দিল, “জামা টা ফুলহাতা ছিল বলেই মনে হয়, কিন্তু অল্প হাতা গোটানো ছিল।“
সাগর বাথরুমে গেছিলো, সে ফিরে এসে জিগ্যাসা করলো, “একটা কথা বলবে আমাকে কেউ, তোমাদের মধ্যে আর কেউ স্বপ্ন দেখে মনে রাখতে পার? মানে ধর স্বপ্ন দেখলে, তারপরে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে খানিকক্ষণ মনে থাকার পরে আমরা সাধারণত ভুলে যাই, কিন্তু কখন স্বপ্নটা মনে থাকে?” ওর মুখ দেখে বুঝতে পারলাম, কিছু একটা ভেবে এসেছে সে, আমি মুখ খুললাম, “আমার খুব কম থাকে, কিন্তু যদি খারাপ কিছু দেখি, আর সেখানে পরিচিত কাউকে দেখি, তখন ঘুম থেকে ওঠার পরেও মনে থাকে, অনেকসময় বিকেল পর্যন্ত মনে থাকে, এমনকি কিছু কিছু স্বপ্ন অনেকদিন মনে থাকে। আর আরেকটা কথা, স্বপ্নে সেক্সের কথাও মনে থাকে, যদি সেটা খুবই উপভোগ্য কিছু হয়, মানে অনেকসময় আমি স্বপ্নে হয়তো কারসাথে সেক্স করলাম, তারপরে বুঝলাম সেই মেয়েটিকে আমি চিনি, হতে পারে তার সাথে আমার কথা হয়নি কখনও, কিন্তু স্বপ্নে তার সাথে আমি মিলিত হয়েছি, তখন একটু খারাপ খারাপ লাগাও থাকে যদিও, কিন্তু মনে থাকে পুরো বিষয়টা, হ্যাঁ তবে একটা কথা, আমি মনে করলেও এরকম জামা প্যান্টের রং মনে থাকার মত কখনও কিছু স্বপ্নে দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না”। আমি থামলাম, বেশি বলে ফেলেছি হয়তো, তবে এখানে বেশি কম বলার উপর কেউ কাউকে বিচার করেনা, পুরনো কথা কারও সাথে শেয়ার করলেও সেটা নিয়ে কেউ কথা শোনায় না, আর সব থেকে বড় কথা, আমাদের দলে কথাটা কথা হিসেবেই নেওয়া হয়, পরে কোন একটা সময় সেটা নিয়ে খোঁচা দেওয়ার জন্যে তুলে রাখা হয়না। সাগর মন দিয়ে শুনল আমার কথা, আদিল শুকনো মানুষ, সে দুটো সিগারেট বানায়, দ্বিতীয় সিগারেটে হাত দেওয়ার অর্থ, সে এখন পুরোপুরি গল্পে ডুবে গেছে, চন্দ্রা চোখ বুজে বসেছিল, সে এবার বলল, “আমার মনে হয় আমরা হয় খুব বেশি আনন্দের জিনিসের কথা ভাবি, আর নয়তো খুব দুঃখের কথা, কিন্তু সেটা স্বপ্নে দেখলে কিন্তু খুব একটা মনে থাকে না, মনে থাকে কখন?” সাগর কথাটা ধরে বলল, “যখন আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বপ্নে অবাক হয়ে যাই”। আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম, ঠিক তাই। কিন্তু কোনজায়গাতে আমরা অবাক হয়েছি, সেটা নিয়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেও সংশয় আছে, নেপালি মেয়ে, না তার জামা, না মেয়েটির সঙ্গে আখের রস বেচার সাথে সেক্সের যোগাযোগ, অন্তত আমার নিজের তাই মনে হচ্ছিল। সৌপর্ণ বোধয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল, বলল, “সন্দীপের স্বপ্নের কোন জায়গাটাতে আমাদের অবাক হওয়ার ছিল?”
চন্দ্রা বলে উঠলো, “অবাক হওয়ার উপাদান সবকিছুতেই ছিল, প্রথমত সে একটি মেয়ে ছিল, দ্বিতীয়ত তার জামা প্যান্টের মধ্যে কোন হাতছানি ছিলোনা, সে কাজ করত, মানে আখের রস বিক্রি করত, তার সঙ্গে কথা বলার পরে সে সেক্সে রাজি হয়, তার হাতের আঙ্গুলে ট্যাটুর কথাও মনে থাকার অর্থ মনে মনে তাকে ভাললেগে গেছিল, তাই সেক্সের ব্যাপারে খুব একটা ভণিতা করতে হয়নি, পুরোটাই তো অবাক করার মত, তাই না?” একটু দম নিয়ে সে বলতে থাকলো, “আরও একটা জিনিস তোমরা ভেবে দেখ, আমরা বিবাহ বিচ্ছিন্ন, কিন্তু মানুষ তো!”
সন্দীপ অপেক্ষা করছিল কিছু বলার, “…আর সেটা একদিনে হয়নি, যতদূর জানি, আমাদের সবাইকে একটা পথের মধ্যে দিয়ে চলে আলাদা হতে হয়েছে, কখনও কখনও সেটা খুব তিক্ততার মধ্যে দিয়ে, আমাদের ভিতরের একটা প্রাণী বোধয় অপেক্ষা করছিল সবকিছুর শেষেও একটু ভালবাসা, অনেকটা সেক্স আর একটু জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকার জন্যে।“
আমাদের ওঠার সময় হয়ে এসেছিল, হাঁটুর ব্যথার কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি, খুব একটা দরকার নেই, ব্যথা এমন একটা জিনিস, যেটা আসে, আবার চলে যায়, বেশি জ্বালাতন করলে ডাক্তার, আর তার ইচ্ছে হলে কিছুটা অংশ কেটে বাদ দেওয়া, ব্যস, বাকিটা, জীবনই আমাদের শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়।
সবাই সবার কথা ভাবতে ভাবতে খেয়ে নিলাম, তারপরে একসাথে হাত ধরে বললাম, “জিন্দেগী মতলব, জিনা শিখো”, এটাও আমাদের একটা নিয়ম। আমাদের সভাভঙ্গ হয় এই মন্ত্র দিয়ে।
সৌগত
মুম্বাই
২৩.১১.২০১৮